রমজান মাসের ফজিলত

রমজান মাসের ফজিলত — রমজান মাস হচ্ছে মুমিনের জীবনের সেরা মাস। জীবনের সমস্ত গুনাহ থেকে পরিত্রাণ এবং পবিত্র হওয়ার সুবর্ণ সময় হচ্ছে এই রমজান মাস। রহমত এবং বরকতের বারিধারা নিয়ে হাজির হয় পবিত্র মাহে রমজান। গুনাহমুক্ত জীবন অর্জন করে নিজেকে জান্নাতের উপযুক্ত করার মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ঘোষিত হচ্ছে রমজান মাস। জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্তকে দামি এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করা প্রতিটি মুমিনের জন্য জরুরি বিষয়।

রমজান মাসের ফজিলত

রমজান মাসের প্রতিটি ক্ষণ মানুষের আমল করার সেরা সময়। আনুগত্য এবং নেকি বৃদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর তায়ালার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মাস। আল্লাহ তায়ালার সমীপে নিজেকে সৌভাগ্যবান করে নেয়ার মাস হচ্ছে রমজান মাস। অন্যান্য সকল মাসের তুলনায় রমজান মাসে সকল প্রকার ইবাদতের ফজিলত অনেক গুণে বেশি। পবিত্র কুরআন এবং হাদিসে এই রমজান মাসের অসংখ্য ফজিলত এবং মর্যাদা বর্ণিত আছে। প্রিয় পাঠক চলুন জেনে নেই রমজান মাসের ফজিলত গুলোঃ

পেজ সূচীপত্রঃ

১। কুরআন অবতীর্ণের মাস

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ রমজান মাস, এতে নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন, যা মানুষের দিশারী এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। (সূরা বাকারা: ১৮৫)। রমজান মাসেই পবিত্র কুরআন মাজিদ অবতীর্ণ হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস, যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা আদ্যোপান্ত হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য এবং মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এই মাস পাবে, সে যেন এই সময় অবশ্যই রোজা রাখে।’ (সূরা বাকারা-১৮৫)।

আরো পড়ুনঃ শবে বরাতের নামাজের নিয়ম

২। লাইলাতুল কদরের মাস

রমজান মাসেই মূলত লাইলাতুল কদর লাভ হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসের ফজিলত বৃদ্ধি করেছেন লাইলাতুল কদরের রাতের মাধ্যমে। লাইলাতুল কদর সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম। এই রাতে ফেরেশতাগণ এবং রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সে রজনী উষার আবির্ভাব পর্যন্ত। 

এই রাতে মানুষের পাপসমূহ ক্ষমা করা হয় এবং সওয়াব বৃদ্ধি করা হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এটা (কুরআন মাজিদ) শবে কদরে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো শবে কদর কি? শবে কদর ১ হাজার মাস অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতারা এবং রূহ প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। সে রাত আদ্যোপান্ত শান্তি-ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত।’ (সূরা কদরঃ ১-৫)।

৩। গুনাহ মাফ হওয়ার মাস

একটি হাদিসে আসছে, আমাদের প্রিয় নবী করিম সাঃ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোজা পালন করবে, তার পিছনের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে ইবাদত করবে, সেই ব্যক্তিরও পিছনের সকল গুণাহ মাফ হয়ে যাবে।’ (বুখারিঃ ২০১৪)।

আরো পড়ুনঃ রমজান সম্পর্কে হাদিস

৪। জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়ার মাস এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করার মাস

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মাদ সাঃ বলেছেন, ‘রমজান মাসের আগমন হলে জান্নাত সমুহের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শয়তানদেরকে বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়।’ (মুসলিমঃ ১০৭৯)। 

তাই শয়তান রমজানের পূর্বে যে সকল স্থানে অবাধে বিচরণ করত রমজান মাস আসার ফলে সে সকল স্থানে যেতে পারে না। শয়তানের তৎপরতা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে, দেখা যায় ব্যাপকভাবে মানুষ তওবা, ধর্মপরায়ণতা, ও সৎকর্মের দিকে অগ্রসর হয় ও পাপাচার থেকে দূরে থাকে। তারপরও কিছু মানুষ অসৎ ও অন্যায় কাজকর্মে তৎপর থাকে। কারণ, শয়তানের কু-প্রভাবে তারা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়েছে।

আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,  রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রমজান মাস উপস্থিত হলে রহমতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শাইতানগুলোকে শিকলে আবদ্ধ করা হয়। —সহীহ মুসলিম: ২৩৮৬

৫। জাহান্নামিদের মুক্তিদানের মাস

আবু সাইদ খুদরি রাঃ বলেন, আমাদের প্রিয় নবী সাঃ বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসের প্রতিদিন এবং রাতে জাহান্নামিদের মুক্তি দেন। রমজানের প্রতিদিন এবং রাতে মুসলমানের দোয়া কবুল করা হয়ে থাকে।’ (মুসনাদে আহমদঃ ৬৬৪)।

আরো পড়ুনঃ গ্যাস্ট্রিক দূর করার উপায়

৬। রোজার মাধ্যমে জান্নাতে সম্মান বৃদ্ধি ঘটে

প্রিয় নবী সাঃ বলেছেন, ‘জান্নাতে এমন ঘর আছে, যার বাইরে থেকে ভেতর ও ভেতর থেকে বাইরের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। একজন সাহাবি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এই ঘর কার জন্যে? নবী সাঃ উত্তরে বললেন, যে ব্যক্তি উত্তম এবং ভালো কথা বলে, মানুষকে খাবার দান করে, নিয়মিত রোজা পালন করে এবং মানুষ যখন রাতে ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাজ আদায় করে তার জন্য এই ঘর। (তিরমিজিঃ ১৯৮৪)।

৭। গুনাহসমূহের কাফফারার মাস

হাদিসে বর্ণিত আছে- রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, ‘বান্দা কবিরা গুনাহে লিপ্ত না হলে, ৫ ওয়াক্ত নামাজ, ১ জুমা থেকে অন্য জুমা এবং ১ রমজান থেকে অন্য রমজান তার মধ্যবর্তী গুনাহসমূহের কাফফারা হয়ে যায়।’ (মুসলিমঃ ২৩৩)।

৮। জান্নাত লাভের মাস

জাবের ইবনে আবদুুল্লাহ রাঃ বলেন, ‘এক ব্যক্তি নবী করিম সাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন, যদি আমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি, রমজান মাসে রোজা পালন করি, হালালকে হালাল মনে করি, হারামকে হারাম মনে করি এবং এসবে কোনো বৃদ্ধি না ঘটাই, তাহলে কি আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো? প্রিয় নবী সাঃ বললেন, হ্যাঁ, পারবে। লোকটি বললো, আল্লাহর শপথ! আমি কোনো কিছু বৃদ্ধি করবো না।’ (মুসলিম-১৫)। 

আরো পড়ুনঃ ছেলেদের ইসলামিক নাম অর্থসহ

৯। রমজান মাস দোয়া কবুলের মাস

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রমজানের প্রতি রাতে এবং দিনে বহু মানুষকে মুক্তি দিয়ে থাকেন এবং প্রতি রাতে এবং দিবসে মুসলিমের দোয়া-প্রার্থনা কবুল করা হয়। তাই প্রত্যেক মুসলমান এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজের কল্যাণের জন্যে যেমন দোয়া প্রার্থনা করবে, তেমনি সকল মুসলিমের কল্যাণ, শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন করবে। (মাজমুউ মুআল্লাফাতুল আলবানীঃ ১০০২)

১০। সুপারিশ লাভের মাস

রোজা এবং কুরআন রোজাদারের জন্যে কিয়ামতের ময়দানের সুপারিশ করবে এবং জান্নাতে নিয়ে যাবে। নবী সাঃ বলেছেন, ‘রোজা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্যে সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে খাবার এবং শারীরিক চাহিদা থেকে দিনের বেলায় বিরত রেখেছিলাম। তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে ঘুমানো থেকে বিরত রেখেছিলাম। তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। সুতরাং রোজা এবং কুরআনের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ-৬৫৮৯)।

১১। হজ্বের সওয়াব লাভের মাস

রমজান মাসে উমরা পালন করা অন্য মাসে হজ্ব পালন করার সমান সওয়াব। নবী করিম সাঃ হজ্ব সম্পন্ন করে ফিরে এসে উম্মে সিনান নামক আনসারি মহিলা সাহাবিকে বলেছিলেন, ‘তুমি আমাদের সাথে হজ্ব করলে না কেন? মহিলা সাহাবি বললেন, আমাদের ২টি উট। আমার স্বামী একটি উটে হজ্বে গমন করেছেন। আরেকটি আমাদের জমিনে পানি দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। (সেজন্য আমি আপনার সঙ্গে হজ্বে যেতে পারিনি) নবী সঃ বললেন, ‘তুমি রমজান মাসে উমরা হজ্ব আদায় করে নিও। রমজান মাসে উমরা আদায় করা মূল হজ্ব আদায়ের মতো কিংবা আমার সঙ্গে হজ্ব আদায় করার মতো।’ (বুখারি-১৮৬৩)।

আরো পড়ুনঃ ফজরের নামাজের শেষ সময়

১২। ইফতার করানোর মাস

রমজান মাসে অন্য রোজাদারকে ইফতার করানোর বিরাট ফজিলত আছে, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে, সেও রোজাদারের মতো সওয়াব লাভ করবে। সেক্ষেত্রে রোজাদারের সওয়াব একটুও হ্রাস করা হবেনা।’ (তিরমিজি-৮০৭)।

১৩। শহীদের সমমর্যাদা লাভের মাস

আমর ইবনে মুররা আল জুহানি রাঃ থেকে বর্ণিত- ‘কজায়া গোত্রের ১ ব্যক্তি নবী করীম সাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নাই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল বলে সাক্ষ্য দেই, পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায় করি, জাকাত আদায় করি, রমজান মাসে রোজা পালন করি। তাহলে আমাকে আপনি কোন দলের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন? নবী সাঃ উত্তর দিলেন, ‘তোমাকে আমি সিদ্দিকিন এবং শহীদদের ভেতরে গণ্য করি’। (ইবনে খুজাইমা-৩/৩৪০)।

১৪। রমজান ধৈর্য ও সবরের মাস

রমজান মাসে ঈমানদার ব্যক্তিগণ খাওয়া-দাওয়া, বিবাহ-শাদি এবং অন্যান্য সকল আচার আচরণে ধৈর্য এবং সবরের এত অধিক অনুশীলন করেন যা অন্য কোনো মাসে বা অন্য কোনো পর্বে করেন না। এমনিভাবে সিয়াম পালন করে যে ধৈর্যের প্রমাণ দেওয়া হয় তা অন্য কোনো ইবাদতে পাওয়া যায়না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ ধৈর্যশীলদের তাে বিনা হিসেবে পুরস্কার দেওয়া হবে। (সূরা যুমারঃ ১০)

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে উপরোক্ত আলোচনা করা বিষয়গুলো সঠিকভাবে বোঝার এবং রমজান মাসের ফজিলত সমূহ লাভ করার তাওফীক দান করুক। আল্লাহুম্মা আমীন। আবার দেখা হবে পরবর্তী কোনো আলোচনায়। আল্লাহ হাফেজ

আরো পড়ুনঃ 

পোষ্ট ক্যাটাগরি: