গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা - গর্ভবতী মায়ের শারীরিক, মানসিক ও অনাগত সন্তানের সুস্থতায় খাবারের ভূমিকা — জীবনে সুখের সবচাইতে সুন্দর পরশ হচ্ছে মা হওয়ার অনুভূতি, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তাকে নিয়ে আশা আকাঙ্খা শুরু হয়ে যায়। প্রতিটি মা চায় তার সন্তান সুস্থ সবল ও পরিপূর্ণতা নিয়ে তার জীবনে আসুক।

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

সন্তানের জন্য যেকোনো কষ্ট মায়েরা হাসিমুখে সহ্য করে, মন না চাইলেও সন্তানের ভালোর জন্য নিজের পছন্দ ত্যাগ করে। অনেকেই মানুষিক বিস্বাদে ভোগেন মেজাজ ও খিটখিটে হয়ে যায়, শরীর ভালো থাকলে মন মানসিকতা ভালো থাকে। বেশির ভাগ সময়ই অনেক মায়েরা শুরুর দিকে ঠিকমতো খেতে পারেনা, গন্ধ লাগে, বমি হয় তারপরেও অনাগত বাচ্চার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে। 

কিছু কিছু মায়েরা প্রথম গভাবস্থায় যতটা নিজের খেয়াল রাখে পরের সময় তা করে না। প্রথম ০-১৩ সপ্তাহে খাবার দৈনন্দিন জীবনের মত খেলেও পরের ১৪-৪০ সপ্তাহে বাড়তি চাহিদা সম্পন্ন খাবার গ্রহণ করতে হয়। ৩০০-৪৫০ ক্যালোরি বেশি গ্রহণ করা প্রয়োজন, এ সময় ভ্রূণের সার্বিক বিকাশের জন্য বাড়তি চাহিদা যুক্ত সুষম খাবার গ্রহণ করতে হয়। গর্ভবতী মায়ের কম ওজন যেমন কম্য নয় তেমন ভাবেই অতিরিক্ত ওজন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়। ব্যালান্স ডায়েট প্ল্যান করে এই সময়টায় খাবার খেতে হবে।

গর্ভবতীর সুষম সমৃদ্ধ খাবার

দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় পুষ্টি সম্পন্ন ও খাবারের গুণাগুণ অক্ষুন্ন রেখে প্রোটিন, ভিটামিন, ফাইবার, খনিজ ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার গর্ভবতীকে খেতে দিতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন টাটকা খাবার খেতে হবে।

দুধ

দুধ হচ্ছে আদর্শ খাদ্য। দুধে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ভিটামিন এ ও ডি বিভিন্ন খনিজ ও অতি অত্যাবশ্যকীয় অ্যাম্যাইনো অ্যাসিড বিদ্যমান। এটি সহজপাচ্য ও খেতেও সুস্বাদু, দুধের ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে ও আয়রন নবজাতকের মস্তিষ্ক গঠনে সাহায্য করে। দুধ বা দুধের তৈরি খাবার যেমন: পনির, পায়েস, ছানা, মাখন দই অনেক উপকারী খাদ্য। দই, মাঠাতে ভালো ব্যাক্টেরিয়া থাকে যা শরীরের খারাপ ব্যাক্টেরিয়া দূর করে হজমে সাহায্য করে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় দুধ অপরিহার্য।

আরো পড়ুনঃ শীতে ত্বকের যত্নে ঘরোয়া উপায়

ডিম

প্রোটিনের সবচেয়ে ভালো উৎস হলো ডিম। ডিমের সাদা অংশ মূলত পুরোটাই প্রোটিন, হলুদ অংশে ফ্যাট, ভিটামিন, আয়রন, ফসফরাস পাওয়া যায়। ডিম কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণ করে নবজাতকের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায়, ডিমের পুষ্টিগুণ মা ও নবজাতকের জন্যে প্রয়োজনীয়। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রান্না করা বা সিদ্ধ ডিম রাখা ভালো, আধা সিদ্ধ ডিম না খাওয়াই ভালো।

মাছ

প্রাণিজ প্রোটিন মাছ। মাছ ফ্যাট, ধাতব লবণ ও মিনারেল সমৃদ্ধ প্রোটিন। সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণ আয়োডিন পাওয়া যায়, বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট মাছ অনেক পুষ্টি সম্পন্ন হয়ে থাকে। মাছ দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে শরীর সুস্থ সবল রাখে, ছোট মাছ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে, কড লিভার এ ওমেগা-3 বিদ্যমান, তাতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ ও ডি পাওয়া যায়।

মাংস

উন্নতমানের প্রোটিন জাতীয় খাদ্য হচ্ছে মাংস। মুরগি, গরু, ছাগল, হাঁসের মাংস বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন সরবরাহ করে। মাংসে ক্যালসিয়াম ফসফরাস লোহা ফ্যাট ও ভিটামিন এ, ডি, ই ভরপুর থাকে। কলিজাতে প্রচুর পরিমাণ লৌহ ও ভিটামিন থাকে। শরীরে কর্মশক্তি উৎপন্ন করে। অতিরিক্ত গরুর মাংস আহারে রক্তচাপ বাড়ার প্রবণতা থাকে, কৌষ্টকাঠিন্য দেখা দেয় তাই গর্ভাবস্থায় স্বল্প পরিমাণে আহার করা উচিত।

শাক-সবজি

পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ও ভরপুর হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাক ও সবজি। শাক ও সবজিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, শরীর ঠান্ডা রাখে। শাক সবজিতে প্রধানত ভিটামিন, পানি, কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায়, যা দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে এবং এটি মা ও নবজাতকের জন্য জরুরী।

আরো পড়ুনঃ কিভাবে বুঝব দোয়া কবুল হয়েছে

ফল

ফলে আছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন, মিনারেল, আয়রন। ফল সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর। মৌসুমী ফল গুলো যেমন: আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ ফসফরাস, লোহা পাওয়া যায়। আমলকি, কমলা লেবু, জাম্বুরা, জলপাই ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়, যা মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। ফলে প্রচুর পরিমাণ পানি থাকে যা শরীরকে ডিহাইড্রেট রাখে। তবে কিছু ফল যেমন: কাঁচা পেঁপে, আনারস ও কামরাঙ্গাতে এক ধরনের এনজাইম থাকে যা প্রথম অবস্থায় ভ্রূণের জন্য ক্ষতিকর।

ডাল

ডাল জাতীয় খাবারে প্রোটিন পরিমাণে বেশি থাকে এবং স্নেহপদার্থ কম থাকে। মসুর, ছোলা মুগ, বুট, খেসারি ইত্যাদি ডাল জাতীয় খাদ্য। উদ্ভিজ্জ প্রোটিন হচ্ছে ডাল, মাছ-মাংসের পরিবর্তে ডাল দিয়ে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা যায়।

বাদাম

বাদামে পাওয়া যায় লৌহ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, জিংক ও কপার। বাদাম শরীরে তাপশক্তি উৎপন্ন করে, কর্মক্ষম রাখতে সহায়তা করে, উচ্চ রক্তচাপ কমায় ও ক্লান্তি দূর করতে সহায়তা করে। বাদামে আছে ওমেগা থ্রি, ফ্যাটি এসিড যা নবজাতকের হৃদপিণ্ড গঠনে ভূমিকা রাখে ও মায়ের হৃদপিণ্ড ভালো রাখে।

কার্ব জাতীয় খাবার

ভাত, রুটি, মিষ্টি আলু, আলু, চিনি গুড় ইত্যাদি কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার। কার্বোহাইড্রেট দেহে তাপ ও শক্তি উৎপাদন করে। দেহের জন্য অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট ক্ষতিকর তাই পরিমান মত কার্বোহাইডেট গ্রহণ করতে হবে। ভাত ও রুটি অল্প পরিমাণে নিয়ে শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে।

মধু

মধুতে আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ইমিউন সিস্টেম বাড়ায় ও ক্ষতিকর জীবাণু দূর করে। মধুকে বলা হয় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ঔষধ। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও মিনারেল বিদ্যমান। চিনির পরিবর্তে মধু ব্যবহার করা যেতে পারে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে মধু। মধু সেবনে ভালো ঘুম হয়, গর্ভবস্থায় যারা অনিদ্রায় ভোগেন তারা মধু খেতে পারেন।

আরো পড়ুনঃ কিভাবে লম্বা হওয়া যায়

লেবু

লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। ভিটামিন সি এর অভাব পূরণে লেবুর ভূমিকা অপরিসীম। তবে যাদের এসিডিটি প্রবলেম আছে তারা কম খেলেই ভাল। লেবুর পানীয় পান করলে শরীর রিফ্রেশ থাকে।

পানি

মানব জীবনের অপরিহার্য একটি উপাদান হচ্ছে পানি। গর্ভাবস্থায় একজন গর্ভবতীকে রোজ দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করতে হবে। পানি প্রয়োজনের তুলনায় কম পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্য ও প্রস্রাবে সংক্রমণ দেখা দিবে। যা গর্ভবতীর জন্য ও নবজাতকের জন্য ক্ষতিকর। একবারে পানি পান না করে সারাদিন অল্প অল্প করে পানি পান করতে হবে। সারাদিন যে পরিমাণ খাবার খাওয়া হয় তার পুষ্টিগুণ পানির মাধ্যমে শরীরের কোষে পৌঁছে যা মা এবং নবজাতকের পুষ্টিগুণ বজায় রাখে।

যে সকল খাবার গর্ভবতীকে পরিহার করতে হবে

জাঙ্কফুড বিভিন্ন ধরনের সফট ড্রিংকস চা ও ক্যাফেইন জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। জাঙ্কফুড ও সফট ড্রিংকস অতিরিক্ত ক্যালরি বহন করে যা শরীরের ওজন বাড়িয়ে তোলে এবং শরীরের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। অতিরিক্ত চা ও কফি সেবনের ফলে অনিদ্রা দেখা দেয়, একজন গর্ভবতীর জন্য পরিপূর্ণ নিদ্রার প্রয়োজন, অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার ও অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে, উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত চিনি বা চিনি জাতীয় খাবার খাওয়া যাবেনা। যেসব খাবারে অ্যালার্জি থাকে সেই সব খাবার পরিহার করাই উত্তম। এই সময়ে আলাদাভাবে বাড়তি ওষুধ সেবন না করাই ভালো।

মা ও নবজাতকের সুস্থতার জন্য সুষম আদর্শ খাবার গ্রহণ করা উচিত। যেসব খাবার গ্রহণে শারীরিক অসুস্থতা বা অসুবিধার সৃষ্টি হয় তা খেয়াল রেখে বাদ দেয়া উচিত। পরিপূর্ণ খাদ্য অভ্যাস গ্রহণের মাধ্যমে শরীর সুস্থ থাকে এতে ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সুষম আহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরো পড়ুনঃ শীতে ত্বকের যত্ন

পোষ্ট ক্যাটাগরি: