রোজা ভঙ্গের কারণ

রোজা ভঙ্গের কারণ – রোজা ভঙ্গের কারণ কয়টি ও কি কি — পবিত্র রমজান মাসে আমরা সঠিকভাবে রোজা পালন করতে চাই কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা রোজা পালনের সঠিক নিয়ম বা কি কি কারণে রোজা ভেঙে যায়। রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময় অনেক প্রশ্নবিদ্ধ হই যেমনঃ স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভাঙ্গে? রোজা ভঙ্গের কাফফারা, নফল রোজা ভঙ্গের কারণ, হস্তমৈথুন, মহিলাদের হায়েয এবং নিফাসের রক্ত বের হওয়া, বমি করা ইত্যাদি। তাই আমরা আজকে রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাল্লাহ। আসুন আমরা জেনে নেই কি করলে বা কোন কোন কাজের জন্য রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়ঃ

রোজা ভঙ্গের কারণ

পেজ সূচীপত্রঃ

রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ

রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ ২টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে ১। রোজা ভঙ্গের কিছু বিষয় আছে যা শরীর থেকে কোনো কিছু নির্গত হওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমনঃ ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা, সহবাস করা, মহিলাদের হায়েয এবং নিফাসের রক্ত বের হওয়া, শিঙ্গা লাগানো কিংবা এই জাতীয় অন্য কোনো কারণে রক্ত বের করা। 

রোজাদারের শরীর থেকে এসকল নির্গত হওয়ার ফলে রোজাদারের শরীর দুর্বল হয়ে যায়। কেননা এসকল নির্গত হওয়ায় দুর্বলতা ও রোজা রাখার দুর্বলতা একত্রিত হয়ে রোজাদার ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই এগুলোকে রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করেছেন।

২। আর কিছু রোজা ভঙ্গের কারণ আছে সেগুলো শরীরে প্রবেশ করানোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেমনঃ ইচ্ছাকৃত ভাবে খাওয়া দাওয়া করা অর্থাৎ কোনো কিছু পানাহার করা। কেননা রোজাদার ব্যক্তি যদি জেনে বুঝে খাওয়া দাওয়া করে কিংবা কোনো কিছু পানাহার করে, তাহলে যে উদ্দেশ্যে রোজার বিধান জারী করা হয়েছে সেটা বাস্তবায়িত হবেনা। [মাজমুউল ফাতাওয়া ২৫/২৪৮] প্রিয় পাঠক চলুন জেনে নেই রোজা ভঙ্গের কারণ গুলো কি কিঃ

আরো পড়ুনঃ ফি আমানিল্লাহ অর্থ কি

রোজা ভঙ্গের কারণ কয়টি ও কি কি?

নিম্নে আমরা রোজা ভঙ্গের প্রধান কারণগুলো তুলে ধরেছি। রোজা ভঙ্গের প্রধান কারণগুলো হচ্ছেঃ পানাহার এবং সহবাস করা। আর রোজা ভঙ্গের অন্য কারণগুলো আল্লাহর নবী রাসূল সাঃ তাঁর হাদিসে উল্লেখ করেছেন। তাই রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ ৭টি যেমনঃ ১। স্ত্রী সহবাস করা ২। পানাহার করা 

৩। এমন কিছু যা পানাহারের স্থলাভিষিক্ত ৪। ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা ৫। মহিলাদের হায়েয ও নিফাসের কারণে রক্ত বের হওয়া ৬। হস্তমৈথুন করা ৭। শিঙ্গা লাগানো বা এমন জাতীয় কোন কাজ করার কারণে রক্ত বের করা। উক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে রোজা ভঙ্গের কারণ। নিম্নে রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

১। স্ত্রী সহবাস করা

এটি সবচেয়ে বড় রোজা নষ্টকারী বিষয় এবং এতে লিপ্ত হলে সবচেয়ে বেশি গুনাহ হয়। রোজা ভঙ্গের কারণ গুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম প্রধান কারণ হচ্ছে স্ত্রী সহবাস করা। রোজা ভঙ্গের কারণ গুলোর মধ্যে স্ত্রী সহবাস করা সবচেয়ে বড় কারণ। আর এই কাজে রোজা থেকে লিপ্ত হলে সবচেয়ে বেশি গুনাহ হয়ে থাকে। যে রোজাদার ব্যক্তি রমজান মাসে দিনের বেলায় ইচ্ছাকৃতভাবে স্ত্রী সহবাস করবে। 

অর্থাৎ ২ খতনার স্থানদ্বয়ের মিলন ঘটাবে এবং পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ লজ্জাস্থানের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যাবে সে ব্যক্তি তার রোজা নষ্ট করল। এতে করে বীর্যপাত হোক আর নাই হোক। রোজাদার ব্যক্তির উপর তাওবা করা, সেদিনের রোজা সম্পূর্ণ করা এবং পরবর্তীতে এই দিনের রোজা কাযা আদায় করে নিতে হবে এবং কঠিন কাফফারা আদায় করা রোজাদার ব্যক্তির উপর ফরয।

আরো পড়ুনঃ শবে কদরের নামাজের নিয়ম

২। পানাহার করা

পানাহার বলতে বোঝায় মুখ দিয়ে এমন কোনো কিছু প্রবেশ করানো যা পাকস্থলীতে পৌঁছে যায়। অনুরূপভাবে যদি নাক দিয়ে কোনো কিছু পাকস্থলীতে পৌঁছানো হয় তবে কিন্ত সেটাও পানাহারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। এই কারণে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তুমি ভালো করে নাকে পানি দাও, যদি না তুমি রোজাদার হও। [সুনানে তিরমিযি (৭৮৮)। সুতরাং যদি নাক দিয়ে পাকস্থলীতে পানি প্রবেশ করানো রোজাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করতো তবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালো করে নাকে পানি দিতে নিষেধ করতেন না।

৩। হস্তমৈথুন করা

হস্তমৈথুন বলতে বোঝায় ইচ্ছাকৃত ভাবে হাত দিয়ে কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে বীর্যপাত ঘটানোকে বোঝায়। হস্তমৈথুন হচ্ছে রোজা ভঙ্গের কারণ। হস্তমৈথুন রোজা ভঙ্গের কারণ তার দলিল হলোঃ হাদিসে কুদসীতে রোজাদার সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ সে আমার কারণে পানাহার এবং যৌ- -ন কর্ম পরিহার করে। 

সুতরাং যে রোজাদার ব্যক্তি রমযান মাসে দিনের বেলায় হস্তমৈথুন করবে সেই ব্যক্তির রোজা নষ্ট হয়ে যাবে ও তার উপরে ফরয হচ্ছে তওবা করা। সেই দিনের বাকী সময় রোজা রাখা ও পরবর্তীতে সেই রোজাটি কাযা আদায় করা। আর যদি এমন হয় যে, রোজাদার ব্যক্তি হস্তমৈথুন শুরু করছে কিন্তু বীর্যপাত হওয়ার আগেই সে তা থেকে বিরত হয়ে গেছে।

তবে তাকে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা করে নিতে হবে এতে করে তার রোজা হয়ে যাবে। বীর্যপাত না হওয়ার কারণে তার রোজাটি কাযা আদায় করে নিতে হবেনা। তাই একজন রোজাদার ব্যক্তির উচিত হলো যৌ- -ন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সকল কিছু থেকে দূরে থাকা এবং নানা রকম কুচিন্তা থেকে নিজেকে প্রতিহত করা।

আরো পড়ুনঃ রমজানের সময় সূচি 2022

৪। ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা

রোজাদার ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করেন তবে সেটা রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে ধরা হবে। দলিল হলোঃ যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃত ভাবে বমি করে তাকে উক্ত রোজা কাযা করতে হবেনা। কিন্তু যে ব্যক্তি রোজা থেকে স্বেচ্ছায় বমি করল তাকে সে রোজা কাযা করতে হবে। সুনানে তিরমিযি (৭২০), আলবানী সহিহ তিরমিযি গ্রন্থে (৫৭৭) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন] ইবনে মুনযির বলেনঃ যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে বমি করলো আলেমদের ঐক্যবদ্ধ অভিমত হলো উক্ত ব্যক্তির রোজা ভেঙ্গে গেছে।[আল-মুগনী (৪/৩৬৮)] 

যে ব্যক্তি মুখের মধ্যে হাত দিয়ে অথবা পেট কচলিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলো অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কিছু শুকেছে বা বারবার দেখেছে এক পর্যায়ে তার বমি চলে আসছে তবে তাকেও রোজা কাযা করতে হবে। তবে হ্যাঁ যদি কারো পেট ফাপা থাকে তার জন্যে বমি আটকে রাখা বাধ্যতামূলক না। কেননা এতে করে তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। [শাইখ উছাইমীনের মাজালিসু শাহরি রামাদান, পৃষ্ঠা-৭১]

৫। এমন কিছু যা পানাহারের স্থলাভিষিক্ত

পানাহারের স্থলাভিষিক্ত বলতে এমন বিষয়কে বোঝানো হয়, যা পানাহারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি ২টি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। যেমনঃ রোজাদারের শরীরে রক্ত পুশ করা। আহত হয়ে রক্তক্ষরণের কারণে কারও শরীরে যদি রক্ত পুশ করানো হয় তাহলে সেই ব্যক্তির রোযা ভেঙ্গে যাবে। যদি কোনো রোজাদার ব্যক্তি এই ধরনের কাজ করে তবে তার রোজা ভেঙ্গে যাবে 

২। খাদ্যের বিকল্প হিসেবে ইনজেকশন পুশ করা অর্থাৎ শরীরের ক্লান্তি দূর করার জন্য স্যালাইন নেওয়া ইত্যাদি। যদি কোনো রোজাদার ব্যক্তি এমন করে তবে তার রোজা ভেঙ্গে যাবে। কেননা এমন ইনজেকশন নিলে পানাহারের প্রয়োজন হয়না। কিন্তু হ্যাঁ প্রয়োজনের কারণে যেসকল ইনজেকশন নেওয়া তবে তা পানাহারের স্থলাভিষিক্ত নয়। বরং চিকিৎসার কারণে দেওয়া হয় যেমনঃ ইনসুলিন, পেনেসিলিন বা শরীর চাঙ্গা করার জন্যে দেওয়া হয় কিংবা টিকা হিসেবে দেওয়া হয় এগুলো রোজা ভঙ্গ করবে না। 

যদিওবা এসকল ইনজেকশন মাংশপেশীতে দেওয়া হোক কিংবা শিরাতে দেওয়া হোকনা কেন। এছাড়াও কিডনী ডায়ালাইসিস করার ক্ষেত্রে রোগীর শরীর থেকে রক্ত বাহির করে সেই রক্ত পরিশোধন করে কিছু কেমিক্যাল এবং খাদ্য উপাদান (যেমনঃ সুগার এবং লবণ ইত্যাদি) যুক্ত করে সেই রক্ত আবার শরীরে প্রবেশ করানো হয় তাহলে এতে করে রোজাদার ব্যক্তির রোজা ভেঙ্গে যাবে। [ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র (১০/১৯)]

আরো পড়ুনঃ শবে বরাতের নামাজের নিয়ম

৬। শিঙ্গা লাগানো বা এমন কোনো কাজ করার কারণে রক্ত বাহির করা

শিঙ্গা লাগানোর মাধ্যমে যদি কোন রোজাদার ব্যক্তির শরীর থেকে রক্ত বাহির করা হয় তবে উক্ত রোজাদার ব্যক্তির রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। দলিল হলোঃ আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ “যে ব্যক্তি শিঙ্গা লাগায় ও যার শিঙ্গা লাগানো হয় উভয়ের রোযা ভেঙ্গে যাবে।” [সুনানে আবু দাউদ (২৩৬৭), আলবানী সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থে (২০৪৭) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

তাই রক্ত দেয়াও কিন্ত শিঙ্গা লাগানোর অর্ন্তভুক্ত। কেননা রক্ত দেওয়ার কারণে শরীরের উপরে শিঙ্গা লাগানোর মতো প্রভাব পড়ে। তাই রোজাদার ব্যক্তির জন্য রক্ত দেওয়া জায়েয নেই। তবে যদি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে কোন রোগীকে রক্ত দেওয়া লাগে তবে তখন রক্ত দেওয়া জায়েয হবে। সেক্ষেত্রে রক্ত দানকারীর রোজা ভেঙ্গে যাবে এবং সেই দিনের রোজা কাযা করবে। [শাইখ উছাইমীনের ‘মাজালিসু শারহি রামাদান’ পৃষ্ঠাঃ ৭১]

আর যদি অনিচ্ছাকৃত কারণে রোজাদার ব্যক্তির রক্ত ক্ষরণ হয় তার রোজা ভাঙ্গবে না। কেননা রক্ত ক্ষরণ তার ইচ্ছাকৃত ছিলোনা। আর দাঁত তোলা, ক্ষতস্থান ড্রেসিং করা অথবা রক্ত পরীক্ষা করা ইত্যাদির কারণে রোজা ভাঙ্গবে না। কেননা এগুলা শিঙ্গা লাগানোর অর্ন্তভুক্ত নয়। কারণ এই কাজগুলো দেহের উপরে শিঙ্গা লাগানোর মতো প্রভাব ফেলেনা।

আরো পড়ুনঃ রমজান সম্পর্কে হাদিস

৭। মহিলাদের হায়েয ও নিফাসের কারণে রক্ত বের হওয়া

মহিলাদের হায়েয এবং নিফাসের রক্ত বাহির হলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) বলেনঃ “যখন মহিলাদের হায়েয হয় তখন কি তারা নামায ও রোযা ত্যাগ করে না?” [সহিহ বুখারী (৩০৪)] তাই কোনো মহিলার হায়েয ও নিফাসের রক্ত বাহির হওয়া শুরু হলে তার রোজা ভেঙ্গে যাবে। এমনকি যদি সেটা ইফতারের সামান্য কিছুক্ষণ আগে হলেও। 

আর যদি কোনো মহিলা বুঝতে পারে যে তার হায়েয শুরু হবে কিন্তু ইফতারের পূর্বে পর্যন্ত রক্ত বাহির হয়নি তবে তার রোজা শুদ্ধ হবে এবং সেদিনের রোজা তাকে আর কাযা আদায় করে নিতে হবেনা। আর যদি কোনো মহিলার হায়েয এবং নিফাসের রক্ত যদি রাত থাকতেই বন্ধ হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি রোযার নিয়ত করেন এবং তার গোসল করার আগেই ফজর হয়ে যায় তবে সেক্ষেত্রে আলেমদের মাযহাব হলো তার রোজা শুদ্ধ হবে। উপরোক্ত আলোচনা করা বিষয়গুলো হলো রোযা বিনষ্টকারী।

পোষ্ট ক্যাটাগরি:

এখানে আপনার মতামত দিন

0মন্তব্যসমূহ

আপনার মন্তব্য লিখুন (0)