আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

মানব শরীরে আয়রন নামক উপাদানটির ঘাটতি পূরণের জন্য আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার উপকারিতা অনেক। আয়রনের অভাবজনিত রোগ অ্যানিমিয়ার চিকিৎসায় আয়রন ট্যাবলেট কার্যকারী ভূমিকা পালন করে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার অপকারিতা দেখা দেয়। এই আর্টিকেলে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করছি।

গবেষণায় জানা যায়, আয়রন এমন একটি খনিজ উপাদান যা দেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রক্তে আয়রনের অভাব দেখা দিলে রক্তশূন্যতা এবং গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আয়রন মূলত ভিটামিন যা রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা এবং শরীরের অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পাদন করে। চলুন তাহলে এই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাকঃ

আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

(toc) #title=(পোষ্ট সূচিপত্র)

আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার উপকারিতা

  • রক্তস্বল্পতা দূর করে
  • রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরি করে
  • চুল ঝরে পড়া রোধ করে
  • দেহের শক্তি বৃদ্ধি করে
  • মস্তিষ্কের কার্যকারিতার বিকাশ ঘটায়
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

১. রক্তস্বল্পতা দূর করে

আমাদের দেহে আয়রনের ঘাটতি হলে সবচেয়ে বেশি যে রোগটি দেখা যায় সেটি হলো রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া। রক্তে আয়রনের অভাবজনিত রোগ প্রতিকার বা প্রতিরোধে আয়রন ট্যাবলেট কাজ করে থাকে।

ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে গেলে তিনি পরীক্ষা রিপোর্টে যদি দেখেন রক্তের লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ কম। তখন তিনি রক্তস্বল্পতার ঔষধ হিসেবে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন তবে। আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার পর লেবুর শরবত বা কমলালেবুর সরবত খেলে তা আপনার শরীরকে আয়রন শোষণে সহায়তা করতে পারে।

২. রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরি করে

আমাদের দেহে লোহিত রক্তকণিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের নাম হলো হিমোগ্লোবিন। হিমোগ্লোবিনের কারণে রক্তের রং লাল দেখায় এবং এই হিমোগ্লোবিন ফুসফুস থেকে শরীরের অন্যান্য টিস্যুতে অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ করে ভূমিকা পালন করে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, হিমোগ্লোবিনের গুরুত্ব কতটা। আর এই হিমোগ্লোবিন তৈরি বা গঠনের কাজে সাহায্য করে আয়রন।

৩. চুল ঝরে পড়া রোধ করে

অনেক সময় আয়রনের অভাবের কারণে চুল ঝড়ে পড়ে থাকে। চুলের ফলিকলগুলির বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত মাত্রায় আয়রনের প্রয়োজন হয়। তবে আয়রনের ঘাটতি থাকলে চুল পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি পায় না। তাই আয়রন ট্যাবলেট খেলে চুল ধরে পড়া অনেকাংশে কমানো সম্ভব হয়।

৪. দেহের শক্তি বৃদ্ধি করে

আয়রন আমাদের দেহের শক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। আমরা জানি জীবদেহে শক্তি একক হল ATP. আর এই ATP উৎপাদনের জন্য আয়রন নামক খনিজ উপাদানের প্রয়োজন পড়ে।

৫. মস্তিষ্কের কার্যকারিতার বিকাশ ঘটায়

আমাদের স্মৃতি, শেখার ইচ্ছা এবং একাগ্রতা ও ক্ষমতাসহ মস্তিষ্কের কার্যকারিতার বিকাশ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আয়রন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৬. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

আয়রন শ্বেত রক্তকণিকা উৎপাদনের সাথে জড়িত। আর আমরা জানি শ্বেত রক্তকণিকা রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এছাড়াও আয়রন ট্যাবলেটের আরো বেশ কিছু উপকারিতার রয়েছে। ক্ষত নিরাময়, মনোযোগের ঘাটতি দূর করা, ক্লান্তি দূর করা সহ আরো বেশ কিছু চিকিৎসার ক্ষেত্রে আয়রন ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার অপকারিতা

আয়রন ট্যাবলেট সেবনের ফলে কারও কারও ক্ষেত্রে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে হতে পারে। যেমন-

  • এপিগ্যাসট্রিক ব্যাথা
  • কোষ্ঠকাঠিন্য
  • পাতলা পায়খানা/ডাইরিয়া
  • পেট ব্যথা
  • অ্যাসিডিটি, বুক জ্বালাপোড়া করা বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা
  • বমি বমি ভাব ও বমি
  • কালচে পায়খানা

গর্ভাবস্থায় আয়রন ট্যাবলেট এর উপকারিতা

গর্ভের শিশুর সঠিক বিকাশ ও গর্ভবতী মায়ের জন্য আয়রন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।গর্ভাবস্থায় শরীরে আয়রনের চাহিদা অনেকাংশে বেড়ে যায়। গর্ভকালীন আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা মা ও শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। তাহলে বুঝতে পারছেন গর্ভাবস্থায় অবস্থায় আয়রন কতটা জরুরী।

এই বাড়তি চাহিদা মেটাতে গর্ভাবস্থায় আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত আয়রন ট্যাবলেট সেবন করা জরুরি। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোনরকম ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন গ্রহণ গর্ভের শিশুর গঠন ও বিকাশে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন- কাজু বাদাম খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা

আয়রন সমৃদ্ধ খাবার তালিকা

আয়রন ট্যাবলেট এর পাশাপাশি কিছু আয়রন সমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত। খাদ্যের মাধ্যমে আয়রন গ্রহণের সময় আয়রনকে আমরা উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয় উৎস থেকে পেতে পারি।কিছু আয়রন সমৃদ্ধ খাবার হলো

মাংস: গরু, ভেড়ার মাংস ও ছাগলের মাংস।

পালং শাক: রান্না করা একটা পালংশাকে থাকে ৬.৫ মিলিগ্রাম আয়রন।

কলিজা: আয়রনের আরেকটি উৎস হলো কলিজা। তবে গরুর কলিজাতে আয়রনের পরিমাণ বেশি।

মটর ও মটরশুঁটি: এক কাপ মটরশুটিতে থাকে ২১ মিলিগ্রাম আয়রন।

সবজি: বিভিন্ন জাতের কচু, কচুর লতি।

বিভিন্ন ডাল: ছোলা, মাসকলাই, মসুর।

বিভিন্ন শুকনো ফল: খেজুর, নারিকেল ও আখরোট।

বিশেষ কিছু মাছ: চাপিলা, ট্যাংরা, কাচকি, মলা, টাটকিনি, শিং, ফেসা ও চেলা।

ডিম: আয়রনের আরেকটি সহজলভ্য উৎস হলো ডিম। আপনি যদি প্রতিদিন আধা কাপ ডিমের কুসুম খান তাহলে প্রায় ৩ মিলিগ্রাম আয়রনের সমপরিমাণ পুষ্টি পাবেন।

বিভিন্ন সবজি: আলু, ব্রকলি ও মাশরুম। খোসা সহ একটি সিদ্ধ আলুতে প্রায় ৩ মিলিগ্রাম আয়রনের সমপরিমাণ পুষ্টি থাকে। তাই চেষ্টা করবেন খোসা সহ সিদ্ধ আলু খেতে।

বিভিন্ন ধরনের বাদাম যেমন- চিনাবাদাম, কাজুবাদাম ও পেস্তা বাদাম।

যারা টাকার অভাবে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ দিয়ে আয়রনের ঘাটতি পূরণ করতে পারেন না। তারা বিভিন্ন ধরনের শাক খেতে পারেন। যেমন: পাট শাক, লাল শাক, সবুজ শাক, সবুজ ডাটা শাক, নটে শাক, সবুজ কচু শাক,মালঞ্চ শাক, বকফুল শাক, মূলা শাক, লাউ শাক, পালং শাক ও পুঁইশাক। এই শাকগুলো খাওয়ার মাধ্যমে আপনি আয়রনের অভাব অনেকটা পূরণ করতে পারবেন।

আমাদের শরীর প্রাণীর উৎস থেকে আগত আয়রন, উদ্ভিদ উৎস থেকে আগত আয়রনের চেয়ে অতি সহজে শোষণ করে। তাই উদ্ভিদ উৎস থেকে আয়রনের শোষণকে বাড়িয়ে তুলতে ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবার যেমন- লেবু, কমলালেবু, টমেটো ইত্যাদি গ্রহণ করা যেতে পারে।

তবে মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র এসব খাবার দিয়ে সাধারণত রক্তশূন্যতা রোগের আয়রনের বাড়তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে অবশ্যই সাপ্লিমেন্ট হিসেবে আয়রন ট্যাবলেটর প্রয়োজন পড়ে। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ট্যাবলেট গ্রহণ করা উচিত।

আরও পড়ুন- মিল্ক শেক এর দাম কত ২০২৪: মিল্ক শেক এর উপকারিতা ও অপকারিতা

কেন আয়রন ট্যাবলেট খাবেন

  • দেহে পুষ্টির ঘাটতি পূরণে 
  • আয়রনের অভাবজনিত কারণে রক্তস্বল্পতা হলে
  • গর্ভবস্থায় আয়রনের ঘাটতি পূরণ করতে

বিভিন্ন কোম্পানির আয়রন ট্যাবলেট এর দাম

ব্র্যান্ড নাম কোম্পানি দাম
জিফ-সিআই স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ১ টি ট্যাবলেট ৫ টাকা। ১ পাতা ট্যাবলেট ৫০ টাকা
ফিওফল-সিআই এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ১ পাতা ২৫ টাকা
ফিওফল এস কে এফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ১ পাতা ২৪ টাকা
ফেরোস্প্যান ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ১ পাতা ২৪ টাকা
ফেরোসিট টিআর একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড ১ পাতা ২৪ টাকা

একজন মানুষের দৈনিক আয়রন চাহিদা

একজন মানুষের দৈনিক আয়রন চাহিদা কতটুকু তার বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন-বয়স, লিঙ্গ এবং অবস্থা।কোন বয়সের মানুষের দৈনিক আয়রন চাহিদা কতটুকু তা নিচের সারণিতে উল্লেখ করা হলো—

বয়স, লিঙ্গ পরিমাণ
০-৬ মাস বয়সী শিশু ০.২৭ মিলিগ্রাম
৭-১২ মাস বয়সী শিশু ১১ মিলিগ্রাম
১-৩ বছর বয়সী শিশু ৭ মিলিগ্রাম
৪-৮ বছর বয়সী শিশু ১১ মিলিগ্রাম
৯-১৩ বছর বয়সী শিশু ৮ মিলিগ্রাম
১৪-১৮ বছর বয়সী পুরুষ ১১ মিলিগ্রাম
১৯-৫০ বছর বয়সী পুরুষ ৮ মিলিগ্রাম
১৪-১৮ বছর বয়সী মহিলা ১৫ মিলিগ্রাম
১৯-৫০ বছর বয়সী মহিলা ১৮ মিলিগ্রাম
গর্ভবতী মহিলা ২৭ মিলিগ্রাম
বুকের দুধ খাওয়ানো মহিলা ৯-১০ মিলিগ্রাম

উপরে তালিকা থেকে সহজেই বোঝা যায় নারীদের ক্ষেত্রে আয়রন কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

সঠিক মাত্রায় আয়রন খাওয়ার উপায়

আয়রন আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী তবে অতিরিক্ত পরিমাণ আয়রন আমাদের শরীরে মারাত্মক করতে পারে। তাই বয়স ও অবস্থা ভেদে পর্যাপ্ত পরিমানে আয়রন গ্রহণ করা উচিত। আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার সময় বা আয়রন জাতীয় খাদ্য খাওয়ার সময় যে সকল বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে তা হলো-

  • আয়রন ব্লকার এড়িয়ে চলা। চা এবং কফির মতো কিছু খাবার আমাদের দেহে আয়রন শোষণে বাধা দিতে পারে। তাই আয়রন-সমৃদ্ধ খাবারের সাথে এসব খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি গ্রহণ করতে হবে। কেননা ভিটামিন সি আমাদের দেহে আয়রন শোষণকে বাড়িয়ে তোলে।
  • আয়রনের প্রয়োজনীয়তা মানুষের বয়স এর উপর নির্ভর করে তাই বয়স বিবেচনা রেখে আয়রন গ্রহণ করা উচিত।
আরো পড়ুন-

উপসংহার

স্বাস্থ্য আপনার অমূল্য সম্পদ। সময় মতো যত্ন না নিলে অনেক অসুখ বাসা বাঁধে। তাই খাদ্য তালিকায় আয়রন জাতীয় খাদ্য রেখে এবং গ্রহণ করে দেহের আয়রন ঘাটতি পূরণ করতে হবে। তা না হলে রক্তস্বল্পতা সহ আরো বিভিন্ন ধরনের জটিল দেখা দিতে পারে।

আশা করি এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে আপনারা আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা, গর্ভাবস্থায় আয়রনের প্রয়োজনীয়তা বিভিন্ন আয়রন ট্যাবলেট এর দাম এসব বিষয়ে সামরিক ধারণা পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

পোষ্ট ক্যাটাগরি: