ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণ | ফিলিস্তিন ও ইসরাইল যুদ্ধের কারণ

ইসরায়েল ফিলিস্তিন সংকট - ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে লড়াই বর্তমানে যেই রকম তীব্র হয়ে উঠেছে সেটি একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতিসংঘ।

সর্বশেষ এই সহিংসতা শুরু হয়েছে জেরুজালেমে ১ মাস ধরে চলতে থাকা তীব্র উত্তেজনার পরে। কিন্তু এখন কথা হ'ল এই ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এই দীর্ঘ সংঘাতের পেছনের কারণটা মূলত কী?

ফিলিস্তিন ও ইসরাইল যুদ্ধের কারণ

একশো বছরের পুরনো সংকট | ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের ইতিহাস

মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন নামের এলাকাটি সেটি ছিলো অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমানদের পরাজয়ের পরে ব্রিটেন ফিলিস্তিনের উপর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।

তখন ফিলিস্তিনে যারা অবস্থান করতো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো আরব সেই সাথে কিছু ইহুদী, যারা ছিলো সংখ্যালঘু। কিন্তু এই ২ সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি হতে থাকলো যখন আন্তর্জাতিক মহল ব্রিটেনকে দায়িত্ব দিলো ইহুদী জনগোষ্ঠীর জন্য ফিলিস্তিনে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।

ইহুদীরা এই অঞ্চলটিকে তাদের পূর্বপুরুষদের দেশ বলে দাবি করেন। কিন্তু আরব বাসিন্দারাও দাবি করে এই ভূমি তাদের আর ইহুদীদের জন্য সেইখানে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় তারা বিরোধিতা করে।

১৯২০ সাল থেকে ১৯৪০ দশকের মধ্যে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে শুরু করে এবং সেখানে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইউরোপে ইহুদী নিপীড়ন আর ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী নিধন যজ্ঞের পর সেখান থেকে ইহুদিরা পালিয়ে গিয়ে তারা নতুন এক মাতৃভূমি গঠন করার স্বপ্ন দেখছিল।

ফিলিস্তিনে তখনি ইহুদী আর আরব বাসিন্দাদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হয়ে গেলো, একই সাথে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছিলো ব্রিটিশ শাসন এর বিরুদ্ধেও। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে এক ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে ২ ভাগ করে দুটি পৃথক রাষ্ট্র ইহুদী এবং আরব রাষ্ট্র গঠন করার কথা বলা হলো।

সেখানে জেরুজালেম থাকবে একটি ইন্টারন্যাশনাল নগরী হিসেবে। ইহুদী নেতারা সেই প্রস্তাব গ্রহণ করলো, কিন্তু আরব নেতারা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। জাতিসংঘের করা এই পরিকল্পনা আজ পর্যন্ত কখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা এবং 'মহা-বিপর্যয়' | ইসরাইলের ইতিহাস

ব্রিটিশরা এই সমস্যার কোনাে সমাধান করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায়। ইহুদী নেতারা তারপর ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র গঠন করার ঘোষণা দেয়। বহু ফিলিস্তিনি নাগরিক এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানান এবং তারপর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

প্রতিবেশী আরব দেশগুলির সৈন্যরা যেখানে যায় যুদ্ধ করার জন্য। হাজার হাজার ফিলিস্তিন নাগরিককে তখন তাদের ঘরবাড়ি ফেলে চলে যেতে হয় বা পালাতে বাধ্য করে। ফিলিস্তিন নাগরিকরা এই ঘটনাটিকে আল নাকব অর্থাৎ মহাবিপর্যয় বলে থাকেন।

পরের বছরে এক যুদ্ধবিরতির সময় যখন যুদ্ধ শেষ হলো, ততদিনে ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনের বাসিন্দাদের বেশিরভাগ যায়গা দখল করে নিয়েছে। জর্ডান দখল করেছিল একটা অঞ্চল যেটা বর্তমানে পশ্চিম তীর নামে পরিচিত এবং মিশর দখল করেছিল গাযা।

জেরুজালেম নগরী বিভক্ত হয়ে যায় ইসরায়েলি বাহিনীরা দখল করে নেয় নগরীর পশ্চিম অংশ এবং জর্ডানের বাহিনী দখল করে পূর্ব অংশ। দুইপক্ষের মধ্যে যেহেতু কখনো কোনো শান্তি চুক্তি হয়নি তাই উভয় পক্ষ অপর পক্ষকে দোষাদোষী করতে থাকে। এই দুই পক্ষের মাঝে পরের দশক গুলিতে তারপর আরও বহু যুদ্ধ সংঘটির হয়েছে।

ফিলিস্তিন মানচিত্র | ইসরাইল মানচিত্র

ফিলিস্তিন ও ইসরাইল যুদ্ধের কারণ

১৯৬৭ সালে আরো একটি যুদ্ধে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের পূর্ব জেরুজালেমে ও পশ্চিম তীর, গাযা, এবং মিশরের সিনাই, সিরিয়ার গোলান মালভূমি অঞ্চল দখল করে নেয়। বেশিরভাগ ফিলিস্তিন নাগরিক শরণার্থী হয়ে থাকে পশ্চিম তীর এবং গাযায়।

প্রতিবেশী সিরিয়া, জর্ডান ও লেবাননে রয়েছে অনেক ফিলিস্তিন নাগরিক। ফিলিস্তিনি এবং তাদের বংশধরদের অন্যান্য পরিচিতদের কাউকে আর তাদের নিজস্ব বাড়ি-ঘরে ফিরতে দেয়নি ইসরায়েল।

ইসরায়েল বলে যে এদেরকে তাদের নিজস্ব জন্মভুমিতে ফিরতে দেয়া হলে সেই চাপ ইসরায়েল কখনও নিতে পারবে না আর ইহুদী রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল এর অস্তিত্বই হুমকির মুখে থাকবে।

ইসরায়েল এখন পর্যন্ত পশ্চিম তীর অঞ্চল দখল করে আছে। গাযা অঞ্চল থেকে যদিও তারা সৈন্য তুলে নিয়েছে। জাতিসংঘের দৃষ্টিতে এই অঞ্চলটি এখন পর্যন্ত ইসরায়েল এর দখলে থাকা একটি অঞ্চল।

ইসরায়েল এখনো সম্পূর্ণ জেরুজালেম নগরীকে তাদের রাজধানী বলে দাবি করে থাকে। অপরদিকে ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দেখতে চায়। সম্পূর্ণ জেরুজালেমকে ইসরায়েল এর রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ হাতে গোনা কয়টি দেশ।

গত পঞ্চাশ বছর ধরে ইসরায়েল এইসকল দখলকৃত জায়গাতে ইহুদী বসতি তৈরি করে যাচ্ছে। ৬ লাখের বেশি ইহুদী বর্তমান সময়ে এসকল এলাকায় বসবাষ করে।

ফিলিস্তিনি বাসিন্দারা বলছে আন্তর্জাতিক আইনে এগুলি হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা বা বসতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়। তবে ইসরায়েল সেটি মনে করেনা।

বর্তমানে কী ঘটছে?

গাযা ও পশ্চিম তীরে এবং পূর্ব জেরুজালেম যে ফিলিস্তিনিরা বসবাস করে তাদের সাথে ইসরায়েলিদের তীব্র উত্তেজনার প্রায়শই চরম লেভেলে। গাযা শাসন করে থাকে ফিলিস্তিনি কট্টরপন্থী দল হামাস। ইসরায়েলের সাথে তাদের অনেক কয়েকবার যুদ্ধ হয়ছে।

গাযার সীমান্তে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল ও মিশর যাতে করে কট্টরপন্থী ফিলিস্তিনি দল হামাসের কাছে কোনো ধরনের অস্ত্র না পৌঁছে।

পশ্চিম তীরের এবং গাযা ফিলিস্তিনিরা বলছেন ইসরায়েল এর নানা ধরনের পদক্ষেপ ও কঠোর বিধিনিষেধের ফলে তারা বর্তমানে খুবই দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। অপরদিকে ইসরায়েল বলে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের সহিংসতা থেকে তারা নিজেদেরকে রক্ষার জন্যে তাদের এই কাজ করে।

এই বছরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে রমজান মাসের শুরু থেকে উত্তেজনা আরো বাড়তে থাকে। তখন প্রায় প্রায় প্রতি রাত্রিতে ফিলিস্তিনদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হচ্ছিলো। পূর্ব জেরুজালেম হতে কিছু ফিলিস্তিন পরিবারকে উচ্ছেদ করে দেয়ার হুমকি ফিলিস্তিনিদের আরো অনেক বেশি ক্ষুব্ধ করে তোলে।

ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণ কি | মূল সমস্যাগুলো কী?

ফিলিস্তিনিরা এবং ইসরায়েলরা বেশ কিছু ইস্যুতে মোটেও একমত হতে পারছেনা। তারমধ্যে আছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ব্যাপারে কী হবে, পশ্চিম তীরে যেসকল ইহুদী বসতি স্থাপন করছে সেগুলি থাকবে নাকি তাদেরকে সরিয়ে নেয়া হবে, জেরুজালেম নগরী কি তাদের মধ্যে ভাগাভাগি করা হবে। 

এছাড়াও সবথেকে জটিল ইস্যু হ'ল- ইসরায়েল এর পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন করার প্রশ্ন। গত ২৫ বছর ধরে শান্তি আলোচনা চলছে ধীরে ধীরে। কিন্তু এই সংঘাতের কোনো সমাধান এখন পর্যন্ত মেলেনি।

ভবিষ্যৎ তাহলে কী?

এক কথায় বলতে গেলে খুব সহজে এই পরিস্থিতির কোনো সমাধান আশা করা যায় না। সংকট সমাধানের সব-সাম্প্রতিক উদ্যোগটি নিয়েছিল আমেরিকা, ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেই সময়।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এটাকে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি বলে বর্ণনা করছিলেন। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এই উদ্যোগটিকে নাকচ করে দিয়েছিল একেবারেই এক তরফা একটি উদ্যোগ বলে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগটি নিয়ে মূল কাজ মোটেই আগায়নি। ভবিষ্যতের যেকোনো শান্তি চুক্তির আগে দুইপক্ষ্যকে জটিল সকল সমস্যার সমাধানে একমত হতে হবে। তা যতদিন পর্যন্ত না হচ্ছে দুইপক্ষের মধ্যে এই সংঘাত ততদিন চলতেই থাকবে।

পোষ্ট ক্যাটাগরি: