মোহরানা ও কাবিন এর মধ্যে পার্থক্য

মোহর বা মোহরানা হলো বিবাহের সময় কনের দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ। যা বর বা বরের পিতার পক্ষ থেকে প্রদান করা হয় তাকে মোহর বা দেনমোহর বলা হয়। মোহরের মাধ্যমেই বিবাহ বৈধ করা হয়। মোহর দেওয়া বাধ্যতামূলক।

মোহরানা ও কাবিন এর মধ্যে পার্থক্য

কাবিননামা হলো বিবাহের একটি লিখিত চুক্তি। আবার একে নিকাহনামও বলা হয়ে থাকে। বিবাহ সম্পূর্ন করার জন্য কাবিননামা অপরিহার্য নয়। কাবিননামা একটি আইনি বাধ্যবাধকতা। বাংদেশের সরকারী আইন অনুযায়ী কাজি সরকারের নির্ধারিত ছকে কাবিননামা সম্প্রদান করবেন। কাবিননামায় থাকে দেন মোহর আদায়, ভরণপশন, উত্তরাধিকার নির্ণয় ইত্যাদি নিবন্ধত একটি লিখিত দলিলনামা।

আজকের এই লেখায় আমরা মোহরানা ও কাবিন এর মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। এই বিষয়ে জানতে আগ্রহী হলে লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন।

মোহরানা ও কাবিন এর মধ্যে পার্থক্য

মোহরানা মানে কি জেনে নিনঃ আরবি শব্দ হচ্ছে ''মাহর" যেটি বাংলাতে ''মোহর" নাম লাভ করেছে। আবার মাহরকে দেনমোহরও বলা হয়ে থাকে। এই নাম করনের একটি কারন হতে পারে যে আগে নগদ মোহর দেওয়া হতো, কিন্তু এটি এখন অন্য ধর্মের কুসংস্কার এর প্রভাবে এটিকে এখন ঋন হিসেবে স্বামীর জিম্মাই রাখা শুরু হয়। তখন থেকে মোহর এর সঙ্গে দাইন (ঋন) শব্দ যোগ দেন মোহর বলা হয়।

মোহর হলো মুসলিম বিবাহের রীতি অনুযায়ী বিবাহের সময় বর ও কনে পক্ষের আলোচনার সাপেক্ষে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ বা সম্পদ। যা তার হবু বর বা বরের পিতার পক্ষ থেকে কনের দাবি মোতাবেক অর্থ পুরন করা। 

আর এই দাবি পূরণের মাধ্যমেই সম্পুর্ন বিয়ে বৈধ্য হবে। এই মোহর দেওয়া বাধ্যতামূলক। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে প্রাচীন আরবে যৌতুক প্রথা চালু ছিল। সেখান থেকে যৌতুক প্রথাকে বিলুপ্ত করে মোহরের দাবি মিটানোর বিষয়টি এসেছে বলে জানা যায়।

স্ত্রী তার স্বামীর নিকট প্রাপ্ত সোনা, রোপা, গহনাও দেন মোহরের হিসেবে গণ্য হবে। তবে বস্ত্র, কসমেটিকস ইত্যাদি দেন মোহর হিসেবে পরিগণিত হবে না। কায়দা করে অনেকেই চাপে ফেলে স্ত্রীর নিকট হতে মাফ করিয়া নেন, যা কোন ভাবেই ইসলাম সমর্থিত নয়। 

বিয়ে সম্পাদন হওয়ার জন্য ইজাব-কবুল জরুরি। বিবাহের ইজাব কবুলের সময় কমপক্ষে তিনজন সাক্ষীর সাক্ষাতে কনের নিকট প্রদত্ত দেনমোহর নগদ এবং বাকির পরিমান উল্লেখ করে যে কোনো বিবাহের প্রস্তাব পেশ করে থাকেন। প্রস্তাব প্রদান কারিকে বিবাহের উকিল বলা হয়। 

ইসলামে মোহর কত হবে তার কোন ধরা বাধা নেই অর্থাৎ কোন সিমারেখা নেই। বরের আর্থিক অবস্থার উপর লক্ষ রেখে মোহর বা দেনমোহর এর পরিমান নির্ধারণ করা হয়। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বিবাহের সময় বিবাহের সবচেয়ে বড় শর্ত হলো মেহর। তোমরা নারীদের দাও তাদের মোহর খুশি মনে। 

এরপর কারা যদি স্বেচ্ছায় কিছু অংশ ছেড়ে দেয় তাহলে তোমরা তা ভোগ করতে পার। তবে এ ব্যাপারে স্ত্রীর উপর কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। সাধারণভাবে দেন মোহর কম ধার্য করাই মুস্তাহাব। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, সে নারী বরকতের মাঝে আছে যাকে প্রস্তাব দেওয়া সহজ ও যার দেন মোহর অল্প।

এছাড়া কুরআনের এক আয়াতে দেন মোহর আদায়ের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, 'হে নবী! আমি তোমাদের জন্য বৈধ করছে তোমাদের স্ত্রী দেরকে, যাদের দেন মোহর তুমি প্রদান করেছো। [সূরা আল- আহজাব, আয়াত ৫০] 

দেন মোহর যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা বুখারীর এই হাদিসে প্রমানিত। সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) বলেন, "আমি অন্যান্য লোকের সাথে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামেনে উপবিষ্ট ছিলাম" তখন এক মহিলা দাঁড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল আমি নিজেকে আপনার জন্য হেরা করলাম, আপনি আমাকে গ্রহন করুন কিন্তু রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুই বললেন না। 

মহিলাটি এরুপ তিনবার বললেন, কিন্তু তিনবারই রাসূল চুপ থাকলেন। তখন এক সাহাবি দাঁড়িয় বলল, আপনি যদি বিয়ে না করেন তাহলে এই মিহলার সাথে আমার বিয়ে দিন। রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নিকট কি এই মহিলাকে দেন মোহর দেওয়ার মতো কিছু আছে? তিনি বললেন না। 

তখন রাসূল (সাঃ) বললেন তোমার বাড়ি থেকে খোঁজ করে একটি লোহার আংটি হলেও নিয়ে আসো। কিন্তু তিনি তাও আনতে পরেনি। তখন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার কি কুরআনের কিছু অংশ মুখস্থ আছে? তখন তিনি বললেন আমার ঐ ঐ সূরা মুখস্থ আছে। রাসূল ( সাঃ) বললেন, মহিলাকে ঐ গুলো শিখিয়ে দিও, সেটা তোমার দেন মোহর। হাদিসটি দ্বারা বুঝিয়ে দিচ্ছে মহিলাকে দেন প্রধান করা কতটা জরুরি।

দেন মোহর মুসলিম নারীদের একটি বিশেষ অধিকার। এই অধিকার মুসলিম আইনের বিবাহের প্রধান উৎস। দেন মোহর স্ত্রী অধিকার সংরক্ষণের জন্য এবং স্ত্রীর অর্থ নৈতিক নিরাপত্তার জন্য দেওয়া হয়।

 আমরা এই আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম যে দেন মোহর স্ত্রীর হক যা স্বামীকে প্রদান করতেই হবে। এবং খুশ মনে প্রদান করতে হবে। দেন মোহর বা মোহরানা না দিয়ে কোন স্বামী যদি মৃ- ত্যু বরন করে তাহলে তাকে রোজ হাশরের এই দেন মোহর অর্থের জন্য দোযখে যাইতে হবে।

আরো পড়ুনঃ ডিভোর্সের কত দিন পর বিয়ে করা যায়

কাবিননামা

একজন গণ্যমান্য ইসলামিক স্কলারের বিয়ে নিয়ে নানা রকম বির্তকের পর দেশে কাবিননামার বিষয়টি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়। কাবিননামা বলেত মুসলিম বিয়ের একটি লিখিত চুক্তিকে বোঝানো হয়। আবার এটাকে নিকাহনামাও বলা হয়ে থাকে।

কাবিননামার কাগজটা কী? সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিবারের ভরনপোষন, উত্তরাধিকার নির্ণয়, সন্তানের পিতৃত্ব পরিচয়, স্ত্রীর দেনে মোহরে যাবতীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে এই কাবিননামা একটি লিখিত দলিল। 

তবে মুসলিম ধর্মে একটি বৈধ বিয়ের জন্য কাবিননামা অপরিহার্য নয়। সেক্ষেত্রে বর পক্ষের অভিভাবক বিয়ের প্রস্তাব দেয় আর সেই প্রস্তাব যদি মেয়ের অভিভাবক গ্রহণ করে তবে সেই বৈধ বিয়ে বলা যায়। 

মুসলিম শরীয়াহ অনুযায়ী প্রবিত্র কালিমা পাঠ করে সাক্ষীদের সম্মুখে অভিভাবকদের অনুমিত কাজী সাহেব বিয়ে পড়িয়ে দিলেই বৈধ বিয়ে বলে গণ্য হবে। কিন্তু আইনগত সুরক্ষার জন্য বাংলাধেশে প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক ভাবে আইন অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন করতে কাবিননামার প্রয়োজন হয়ে থাকে। 

মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিষ্ট্রেশন আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী প্রতেকটি বিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। কাবিননামা না করা থাকলে মেয়েরা যে কোনো সময় প্রতারিত জতে পারে।

রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী কাবিননামা না করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনমত বিয়ের ৩০ দিনের নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। অন্যথায় ৩ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ২ বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড কিংবা উভয় শাস্তিই হতে পারে। 

সামগ্রিক বিবেচনায় আইন সুরক্ষা ও প্রতারণার হাত থেকে রক্ষার জন্য বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন করা উচিত বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর কাজির আইনগত দায়িত্ব হলো, স্বামী ও স্ত্রীর উভয় পক্ষকে কাবিননামার বিষয় বস্তু ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া।

আরো পড়ুনঃ টিউমার ভালো করার ঘরোয়া উপায়

বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন এর প্রয়োজনীয়তা কেন?

বিয়ের কাবিননামা থাকলে বিয়ের পর বিয়ের সত্য অস্বীকার করতে পারে, কাবিননামা থাকলে স্ত্রীর অনিমতি ব্যথীত পুনরায় বিবাহ করতে পারে না, কাবিননামা থাকলে স্বামী-স্ত্রীর মৃ- ত্যু হলে দুজনের মধ্যে যিনি বেচে খাকবেন তিনি সম্পত্তি থেকে বৈধ অংশ আদায় করতে পরবেন। কাবিননামা রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকলে প্রতারিত হতে পরেন যে কোনো সময়। তাই সকলের উচিত কাবিননামা রেজিষ্ট্রেশন করে রাখা।

আশা করি আমাদের আজকের এই মোহরানা ও কাবিন এর মধ্যে পার্থক্য আলোচনার মাধ্যমে আপনি সঠিক ধারণা পেয়েছেন। মোহরানা ও কাবিন এর মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে যদি আপনি আরো বিস্তারিত জানতে চান অথবা আপনার কোনো প্রকার প্রশ্ন থাকে তা আমাদেরকে মেসেজ অথবা কমেন্টের মাধ্যমে জানাতে পারেন। শেষ পর্যন্ত লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ

পোষ্ট ক্যাটাগরি: